
বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ মহামারির দৃশ্যমান সূত্রপাত চীনের উহান শহর থেকে। দ্রুতই বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। বিশ্বে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে এবং মানুষের জীবনে এই মহামারি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশে এই মহামারি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে ব্যবস্থাগুলো নিয়েছে, সেগুলো খুব একটা আলোচনায় আসেনি। বরং নজিরবিহীন এই মহামারি প্রতিরোধ করতে গিয়ে ঘটে যাওয়া কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি বা ব্যর্থতাই সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে। অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে বিশ্ববাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়েই। কিন্তু ইতিবাচক দিকগুলো পর্দার অন্তরালেই থেকে গেছে। বিশ্ববাস্তবতা মাথায় রেখে সরকারের করোনা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করলে এ নিয়ে স্বচ্ছ ধারণার সৃষ্টি হবে।
চীনে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাস দেশটিতে এত দ্রুত ছড়িয়েছিল যে তারা রোগীদের হাসপাতালে জায়গা দিতে পারেনি। মাঠে তাঁবু করে তাদের চিকিৎসা দিতে হয়েছে। অনেককে রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। আগে করোনাভাইরাসের একাধিক প্রকরণ দেখা গেলেও এই কভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসটি একেবারেই নতুন। এই ভাইরাসের উৎপত্তি কিভাবে, কোন প্রাণী থেকে বা কোথা থেকে, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের সক্ষমতা কতটুকু, মৃত্যুর হারই বা কী—এসব প্রাথমিক পর্যায়ে কারোরই জানা ছিল না। কিভাবে এই ভাইরাস আক্রমণ করে, কী কী উপসর্গ কখন দেখা যায় বা মানুষ ঠিক কী কারণে বা কখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, তা কেউই জানত না। এর চিকিৎসাপদ্ধতিও পৃথিবীর কাছে অজ্ঞাত ছিল। পৃথিবীর অনেক বড় ও ধনী রাষ্ট্রগুলো, যেমন—ইউরোপের ইতালি, স্পেন বা যুক্তরাষ্ট্র, যারা অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী, যাদের স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধা ও দক্ষ জনবল অনেক বেশি, তারাও এই ভাইরাস মোকাবেলায় হিমশিম খেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গেছে লাখখানেক মানুষ।
সৌভাগ্যবশত অন্য অনেক দেশের তুলনায় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কিছু সময় আমরা পেয়েছি। চীনে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখার সময় থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি ঘোষণার পরপরই আমাদের দেশে বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। প্রতিটি প্রবেশমুখে স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত প্রায় আট লাখ বিদেশাগত মানুষকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। সব বিদেশাগত ব্যক্তিকে লিফলেট ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশনা, যেমন—কিভাবে বাড়িতে কোয়ারেন্টিন করতে হবে, অসুস্থ হলে কী করণীয় ইত্যাদি দেওয়া হয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থা অন্য দেশগুলোতে নেওয়া হয়নি।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীন থেকে দুইবারে প্রায় ৫০০ আটকে পড়া বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত আনা হলে আমরা সফলভাবে তাঁদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছি। তাঁরা সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এরই মধ্যে প্রায় আট লাখ লোক দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে প্রবেশ করেছেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিন করবেন মর্মে লিখিত গ্রহণ করা হয়েছিল, যা অনেকেই মানেননি। চীনের মতো তাঁদের গুলি করে কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্য করা যায়নি।
আমাদের দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। তারও আগে, ১ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক আন্ত মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা কভিড প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিভাগীয়, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১৮টি মন্ত্রণালয়কে এই কভিড মোকাবেলায় সম্পৃক্ত করা হয়। ওই কমিটিগুলোর মাধ্যমে সব নির্দেশনা প্রদান, স্বাস্থ্যবিধি এবং হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মার্চের ২৬ তারিখ থেকে দেশব্যাপী সাধারণ লকডাউন কার্যকর করা হয়। পরবর্তী সময়ে এলাকাভিত্তিক জোনিং সিস্টেম শুরু করা হয়। মাত্র একটি টেস্টিং ল্যাব ও ১৫০টির মতো নমুনা পরীক্ষা দিয়ে শুরু করলেও প্রয়োজনের তাগিদে এখন সারা দেশে ৮০টি টেস্টিং ল্যাব স্থাপিত হয়েছে। দৈনিক সর্বোচ্চ ১৮ হাজার পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ও হচ্ছে। টেস্টিং ল্যাবের প্রয়োজনীয়তা কারো জানা ছিল না। টেস্টিং ল্যাব স্থাপনে যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবল একই সময়ে ব্যবস্থা করা ছিল একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। সে সময় সারা বিশ্বে লকডাউন চলছিল। দেশে-বিদেশে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলে কিট সংগ্রহ করা দুরূহ ছিল। তার পরও চিকিৎসাসেবা ও নমুনা পরীক্ষা অব্যাহত রাখা হয়েছে এবং দ্রুত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
কভিড আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় প্রাথমিকভাবে অন্যান্য রোগীর সঙ্গে কভিড-১৯ চিকিৎসা প্রদান সম্ভব ছিল না। প্রথমে কুর্মিটোলা, কুয়েত মৈত্রী, মুগদা হাসপাতালসহ প্রায় ১৫টি হাসপাতাল ঢাকায় কভিড-১৯ চিকিৎসা শুরু করে। এরপর সারা দেশে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা কভিড হাসপাতাল ও আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি করা হয়।
আমাদের মেডিক্যাল সোসাইটি ও অন্যান্য সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত বিশেষ কমিটি স্বাস্থ্য গাইডলাইন তৈরি করেছে। আমরা বিশ্বের সব দেশের, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও চীনের কার্যকর চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এই চিকিৎসাব্যবস্থাও প্রথম দিকে কারো জানা ছিল না। তখন ভেন্টিলেটরের প্রসঙ্গে সবাই সরব ছিল। সে সময় বিশ্বে লকডাউনের ফলে অধিক হারে ভেন্টিলেটর সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। এসব নিয়ে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয় সরকারকে। অথচ পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় যে ভেন্টিলেটর খুব কার্যকর নয়। বরং দেখা গেছে যে রোগীকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করাই অন্যতম কার্যকর চিকিৎসাব্যবস্থা। এর মধ্যে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অন্যতম। হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কভিড আক্রান্ত বিশ্বে বেশ অপ্রতুল। আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা যখন থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, তখন থেকেই হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সংগ্রহের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
রাতারাতি প্রতিটি কভিড হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। গত তিন মাস আগে অনেক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, ডায়ালিসিসের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কারণ কভিড-পূর্ববর্তী বাস্তবতায় সেগুলোর প্রয়োজন ছিল না। এরই মধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনেক হাসপাতালে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে বা স্থাপনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ঢাকার ভেতরে কুর্মিটোলা, কুয়েত মৈত্রী, মুগদা, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুরসহ অন্যান্য হাসপাতালে গত দুই মাসের মধ্যে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। ৭২টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন এবং লিকুইড অক্সিজেন প্লান্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যেগুলো কভিড চিকিৎসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একপর্যায়ে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে ঢাকা শহরে বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টার, সিটি করপোরেশন মার্কেট, দিয়াবাড়ী, মহানগর হাসপাতালসহ প্রায় ১৫টি বিশেষ কভিড হাসপাতাল চালু করা হয়েছে। কভিড রোগীদের পাশাপাশি নন-কভিড বিভিন্ন অসংক্রামক রোগী, যেমন—ক্যান্সার, কিডনি, হৃদেরাগ, ডায়াবেটিস রোগী এবং গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা ও প্রসূতিসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হয়। যদিও তিন মাসে হাসপাতালের সংখ্যা দ্বিগুণ করা সম্ভব নয়, তবে তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়নি।
ডাক্তার-নার্সদের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা ও রোগীদের চিকিৎসাসেবা বিষয়ে সারা দেশের সব হাসপাতালে চিকিৎসা প্রটোকল দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শে ডাক্তার-নার্স ও অন্য সেবাকর্মীদের সুরক্ষার জন্য সুরক্ষাসামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলো সংগ্রহ ও সারা দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বিতরণ তথা সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা একটি দুরূহ কাজ ছিল। বিশ্বজুড়েই পিপিই সংগ্রহ ও বিতরণে জটিলতা দেখা গেছে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত দেখেছি। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশেও এই জটিলতা ছিল; কিন্তু সরকারের আপ্রাণ চেষ্টার ফলে দ্রুতই পিপিই-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা গেছে। দেশের গার্মেন্ট খাতের মাধ্যমে দেশীয়ভাবে তৈরি করে পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। কোনোভাবেই এই সুরক্ষাসামগ্রীর ঘাটতি হতে দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শে চিকিৎসাকর্মীদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁদের থাকা-খাওয়ার জন্য ঢাকা শহরে প্রায় ৫০টি হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতায়াতের সুব্যবস্থা করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে সমন্বয়ের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি কো-অর্ডিনেশন সেল করা হয়েছে, যেখানে সব বিষয়ে যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থা তথ্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে এবং সেখান থেকে ডঐঙ, টঐঋচঙ এবং ইউনিসেফের কর্মকর্তারাও প্রতিনিয়ত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। জনগণ যাতে সার্বক্ষণিক কভিড বিষয়ে জরুরি পরামর্শ পেতে পারে সে জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ৫০টি হটলাইন চালু করা হয়।
টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় চার হাজার ডাক্তার প্রতিদিন দেশের সব হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা রোগীদের চিকিৎসা বিষয়ে জরুরি পরামর্শ প্রদান করেছেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুততার সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ১০ হাজার হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ক্রয়ের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; যদিও অক্সিজেন সিলিন্ডারের এখন কোনো সংকট নেই। যেহেতু ১০ দিন সেবাদানের পর চিকিৎসাকর্মীদের ২০ দিন কোয়ারেন্টিনের প্রয়োজন পড়ে, তাই তাত্ক্ষণিক এই ঘাটতি পূরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় চার হাজার ডাক্তার, ছয় হাজার নার্স ও তিন হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া অনেকাংশে সম্পন্ন করা হচ্ছে।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের স্বাস্থ্য বাজেটে ঘাটতি রয়েছে। আমাদের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতাল, আইসিইউ, ডায়ালিসিস বেড, ডাক্তার-নার্সের স্বল্পতা ও যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি নিয়েও আমরা মানুষকে সুষ্ঠু সেবার ব্যবস্থা করেছি। ১৬ কোটি মানুষসমেত আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ঢাকা শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ বসবাস করে। এই ধরনের ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সহজ নয়। আমাদের কোনো রোগীকে অন্যান্য দেশের মতো হাসপাতালের বাইরে থাকতে হয়নি। কেউ সরকারি হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছে এই নজির নেই।
আমাদের ডাক্তার-নার্স ও অন্য সেবাকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন রোগীদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, অনেক সেবাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালকে চিকিৎসাসেবায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। শুরুতে তারা সেবা দিতে পারছিল না। তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও ডাক্তার দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে সব কভিড ও নন-কভিড হাসপাতাল চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ রোগীর সেবা দিতে গিয়ে সাময়িক অসুবিধা হতে পারে, সে জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করি। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় তিন হাজার শয্যা খালি রয়েছে, সেখানে রোগী নেই। ফলে অন্যান্য রোগীর জন্য হাসপাতাল খুলে দিতে হবে।
এই মহামারি যুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নেতৃত্ব দিয়ে কাজ করে গেছে। লকডাউনের সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় মন্ত্রণালয় সার্বিক সহযোগিতা করেছে। এ জন্য তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই।
দুঃখের বিষয়, আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সেবায় সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট ও সরকারবিরোধীরা নানাভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপপ্রচার করছে, একের পর এক দোষারোপ করছে, মিথ্যাচার করছে, হেয় প্রতিপন্ন করছে। এই পরিস্থিতিতে এমনটি কাম্য নয়। তারা জনগণের সম্মুখে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। অথচ এই সংক্রমণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করা সবার দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। পৃথিবীর কোথাও কভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য এভাবে হেয় করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদেরও ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। যে সময় সবাই মিলে দুর্যোগ মোকাবেলার কথা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা, সেই সময় এরূপ বৈরী আচরণ ন্যক্কারজনক। কিছু সংস্থা আছে তাদের কাজ হলো সমালোচনা করা, মিথ্যাচার করা, সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, ব্যর্থ প্রমাণ করা। তাদের কখনো মানুষের পাশে দেখা যায়নি। তাদের দেখা যায় টিভির পর্দায়। পত্রপত্রিকায় বিবৃতির মাধ্যমে। জনমনে তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, ভুল তথ্য উপস্থাপন করে।
এ ছাড়া কিছু আলোচিত-সমালোচিত ঘটনার বেলায় মাত্রাতিরিক্ত রং দেওয়া হয়েছে। মাস্কের বিষয়ে সিএমএসডির সাবেক পরিচালক, যিনি এটি অর্ডার দিয়েছেন, রিসিভ করেছেন আবার ফেরতও দিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য লিখিতভাবে পত্রপত্রিকায় এবং টিভিতে প্রচারিতও হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসাকর্মীদের থাকা-খাওয়া, পরিবহনের বিষয়টিও পরিচালক গণমাধ্যমের সম্মুখে বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট করেছেন। সম্প্রতি রিজেন্ট ও জেকেজি হাসপাতালের বিষয়টিও গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে। এ বিষয়ে সবাই এখন প্রকৃত সত্য বুঝতে পেরেছে কারা দায়ী। কাউকেই ছাড় দেওয়া হয়নি। দায়ীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা সরকার নিচ্ছে। ভবিষ্যতেও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যখন, যেখানেই অনিয়ম পরিলক্ষিত হবে সেখানেই এর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনারা জানেন, জীবন-জীবিকার জন্য সরকারকে অনেক কিছুই শিথিল করতে হয়েছে। গার্মেন্ট চালু রাখতে হয়েছে, রমজানে মসজিদে যাওয়া, ঈদে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিতে হয়েছে। ফলে অনেক স্বাস্থ্যবিধি বিঘ্নিত হয়, যে কারণে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতার বাইরে ছিল।
আমরা আশা করি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, নেতারা প্রকৃত বিষয়গুলো গণমাধ্যমে তুলে ধরলে, জনগণ প্রকৃত সত্য জানবে, বিভ্রান্তি দূর হবে এবং অপপ্রচারকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা ও সুপরামর্শ আমাদের এই দুঃসময়ে স্বাস্থ্যসেবায় আরো গতি ও স্বচ্ছতা আনবে।
লেখক : মোহাম্মদ এ আরাফাত
চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন
(কালের কন্ঠ)